আজ শুরু অনির্দিষ্টকালের অসহযোগ আন্দোলন

অনির্দিষ্টকালের জন্য আজ থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। সেই সঙ্গে সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় দেয়া ভাষণ থেকে অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আজ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনে দেশের মানুষকে কী কী নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেই খাতগুলো উল্লেখ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে জরুরি এক নির্দেশনায় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনো নাগরিক কোনো কর বা খাজনা দেবে না। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিলসহ কোনো ধরনের বিল পরিশোধ করবে না। সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও কল-কারখানা বন্ধ থাকবে। কেউ অফিসে যাবেন না, মাস শেষে বেতন তুলবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো ধরনের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবেন না। সব ধরনের সরকারি সভা-সেমিনার ও আয়োজন বর্জন করবেন। বন্দরের কর্মীরা কাজে যোগ দেবেন না। কোনো ধরনের পণ্য খালাস করবেন না।’

জরুরি নির্দেশনায় আসিফ মাহমুদ আরো বলেন, ‘দেশের কোনো কল-কারখানা চলবে না, গার্মেন্টসকর্মী ভাই-বোনেরা কাজে যাবেন না। গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। শ্রমিকরা কেউ কাজে যাবেন না। জরুরি ব্যক্তিগত লেনদেনের জন্য প্রতি সপ্তাহের রোববার ব্যাংকগুলো খোলা থাকবে। পুলিশ সদস্যরা রুটিন দায়িত্ব ছাড়া কোনো ধরনের প্রটোকল ডিউটি, রায়ট ডিউটি ও প্রটেস্ট ডিউটিতে যাবেন না। শুধু থানা-পুলিশ নিয়মিত থানার রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। বিজিবি ও নৌবাহিনী ছাড়া অন্যান্য বাহিনী ক্যান্টনমেন্টের বাইরে দায়িত্ব পালন করবে না। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যারাক ও উপকূলীয় এলাকায় থাকবে।’

আসিফ আরো বলেন, ‘আমলারা সচিবালয়ে যাবেন না। জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা নিজ নিজ কার্যালয়ে যাবেন না। দেশ থেকে যেন একটি টাকাও পাচার না হয়, তার জন্য সব অফশোর লেনদেন বন্ধ থাকবে। বিলাসদ্রব্যের দোকান, শোরুম, বিপণিবিতান, হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানপাট বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।’

অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে জরুরি ওই নির্দেশনায় কিছু সেবা খাত খোলা রাখার কথা উল্লেখ করেন আসিফ মাহমুদ। তিনি জানান, অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যেও হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, জরুরি পরিবহন সেবা (ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবহন), অ্যাম্বুলেন্স সেবা, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবহন, জরুরি ইন্টারনেট-সেবা, জরুরি ত্রাণসহায়তা ও এ খাতে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবহন সেবা চালু থাকবে।

আজ থেকে ৫৩ বছর আগেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগের যে ডাক দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে আজকের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগের ঘোষণা মিলে যায়। ১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধুর ডাক দেয়া ওই অসহযোগ আন্দোলন ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলে। 

অসহযোগের ডাক দিয়ে ৭ মার্চ ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘‌আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। ’

রেসকোর্স ময়দানের সেই ভাষণে বলেন, ‘‌সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো, কেউ দেবে না।’ 

রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ওই ভাষণে তিনি আরো বলেন, ‘‌২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর দেয়া অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক কয়েকটি দিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, একটি স্বাধীন দেশে অসহযোগ আন্দোলন ও পরাধীন দেশে অসহযোগ আন্দোলন ভিন্ন বিষয়। এছাড়া সময়টাও বিবেচনায় নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অসহযোগ আন্দোলনের‌ প্রধান একটি দিক রয়েছে। একটি পরাধীন দেশের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এক রকম, আর স্বাধীন দেশের অসহযোগ ঘোষণার প্রেক্ষাপট অন্য রকম। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনক্ষোভ। বিশেষ করে স্বাধীন দেশে নির্বিচারে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেখানে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে, সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেশে এখন যুবলীগ, ছাত্রলীগ রাস্তায় নেমে মানুষের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। সেই প্রেক্ষিতে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য এ অসহযোগ আন্দোলন অনেক প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। যেহেতু এ আন্দোলনের একটি সন্ধিক্ষণ তৈরি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে এটি অনেক ফলপ্রসূ হতে পারে। এ সন্ধিক্ষণটার একটি পরিণতি তো টানতে হবে। এ পরিণতি টানার জন্য সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে। যদিও সবাই সম্পৃক্ত। কিন্তু অসহযোগের মাধ্যমে সবার সম্পৃক্ততাকে এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। সেটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা আগামী এক সপ্তাহ দেখতে হবে। ’

১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। অসহযোগ আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌১৯৭১ সালে আমরা অসহযোগ আন্দোলন করেছি। আমাদেরকে বিভিন্নভাবে আমাদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে পাকিস্তানিরা। সে সময় আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার ছিলাম। কিন্তু সেটিতে কর্ণপাত না করার ফলেই অসহযোগ আন্দোলন। এর সঙ্গে আজকেরও মিল রয়েছে। আজকে যে আন্দোলন কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসেবে ধরা হয়, সেখানে এটি হলো রোগের উপসর্গ। এখানে রোগ হলো দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, ভোটাধিকার হরণ, অন্যান্য নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। তখন আমাদের অর্থনীতি ছিল ছোট। ফলে বিশ্ব অঙ্গনে ওই অর্থে অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বাংলাদেশ। কিন্তু এখন আমাদের সাপ্লাই চেইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইনের সম্পৃক্ততা আছে। আমরা বিশ্ব অঙ্গনে অতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও অন্তত বৈশ্বিক সম্পৃক্ততা আমাদের জন্য গুরুত্ব।’

সূত্রঃ বণিক বার্তা

এই বিভাগের আরও সংবাদ